Akbar

                              AKBAR

 
১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৫ অক্টোবর মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি মহামতি আকবর সিন্ধু প্রদেশের অন্তর্গত অমরকোটের রাজা রানা বিরসলের গৃহে আশ্রিতা হুমায়ূন পত্নী হিমাদাবানোর  গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন । আকবরের বাল্য জীবন চরম দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়, ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আকবরকে প্রথম জনসমক্ষে দেখা যায় `সুন্নত'(circumcision)অনুষ্ঠানে। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ এর মতে, উক্ত অনুষ্ঠানে আকবরের জন্মের সময় দেওয়া নাম বদরুদ্দীন এর পরিবর্তে`জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবর নামকরণ করা হয়। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী রাজপুত্র যেভাবে মানুষ হতেন, আকবর  সেভাবে ধাত্রীমাতা দের কাছে লালিত-পালিত হতে থাকেন। এই ধাত্রীমাতাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মাহম আনগা।

১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৫ বছর বয়সে আকবর এর উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।একের পর এক শিক্ষক নিয়োগ করা হয় কিন্তু তারা সকলেই আকবরকে লেখাতে ও অক্ষর পরিচয় করতে ব্যর্থ হন।আকবর লেখাপড়া চেয়ে খেলাধুলা ভালোবাসতেন এবং বিভিন্ন জীবজন্তু বিশেষ করে ঘোড়া, কুকুর,উট ও পায়রা ভালোবাসতেন।বাল্যকাল থেকে তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ কিন্তু বসে অক্ষর পরিচয় করার মত ধৈর্য তার ছিল না। তিনি অল্পবয়স থেকে ঘোড়ায় চড়া অস্ত্রবিদ্যা তীক্ষ্ণ পারদর্শী হয়ে ওঠেন।হুমায়ুনের মত বিদ্বান পিতার পক্ষে পুত্র আকবরকে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ করে তোলা সম্ভব হয়নি। 1551 খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুনের অপর ভাতা হিন্দালের মৃত্যু হলেআকবর কি আনুষ্ঠানিকভাবে গজনীর শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয় এবং হিন্দালের কন্যা রুকিয়া বেগম এর সঙ্গে আকবরের বিবাহ দেওয়া হয়। হুমায়ুন যখন ভারতবর্ষ পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান করেন, তখনো পর্যন্ত অর্থাৎ 1554 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আকবর গজনীর নামমাত্র শাসক ছিলেন।হুমায়ুন ভারতবর্ষ পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান করার সময় মুনিম খান কে আকবরের অভিভাবক নিযুক্ত করে যান। শেরশাহের অপর এক ভাইপো সিকন্দার সুর যিনি দিল্লির সিংহাসনে দাবিদার ছিলেন তিনি 1555 খ্রিস্টাব্দের 22 শে জানুয়ারি সিরহিন্দর যুদ্ধে পরাজিত হন এবং আকবর বিজয়ীর মর্যাদা পান। অতঃপর আকবর অনুষ্ঠানিকভাবে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষিত হন। এই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যে হুমায়ুন দিল্লীর সিংহাসন পুনরুদ্ধার করলে, আকবর কে লাহোরের শাসক নিযুক্ত করা হয় এবং হুমায়ুনের বিখ্যাত কূটনীতিবিদ ও প্রতিভা সম্পন্ন দক্ষ সৈনিক বৈরাম খানে কে মুনিম খানের স্থলে আকবরের অভিভাবক নিযুক্ত করা হয়। আকবরের বয়স তখন মাত্র 13 বছর।
1556 খ্রিস্টাব্দে 27 শে জানুয়ারি হুমায়ূনের মৃত্যু হয়, ঐতিহাসিক বাদায়ুনি কাছ থেকে জানা যায় যে, বিনা বাধায় আকবরের সিংহাসন আরোহন সুনিশ্চিত করার জন্য হুমায়ূনের মৃত্যু সংবাদ বৈরাম খান গোপন রাখেন। তুর্কি  নৌ-অধ্যক্ষ সিদি আলি রইস তখন সৌভাগ্যবশত দিল্লিতে উপস্থিত ছিলেন। তার কাছ থেকে জানা যায়,হুমায়ূনের মতো দেখতে এক ব্যক্তিকে সাজিয়ে জনসমক্ষে হাজির করে আশ্বস্ত করা হয় যে- হুমায়ুন আরোগ্য লাভ করেছেন।কিন্তু 1556 খ্রিস্টাব্দে 11 ফেব্রুয়ারী তার মৃত্যু সংবাদ জনসমক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় এবং দিল্লিতে আকবরের নামে খুৎবা পাঠ করা হয়। আকবর তখন পাঞ্জাবে সিকান্দার সুর এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যস্ত ছিলেন। এই সংবাদ আকবরের কাছে পৌঁছলে, আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান তৎক্ষণাৎ সিরহিন্দ দুর্গে একটি ইটের মঞ্চ তৈরি করেন এবং 1556 খ্রিস্টাব্দে 14 ই ফেব্রুয়ারি সেই মঞ্চে আকবরের সিংহাসন আরোহণের অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তখন আকবরের বয়স 13 বছর 4 মাস। আকবরের এই অভিষেক পর্বের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক তাৎপর্য আছে। ড. আর. পি.  ত্রিপাঠী বিনা বাধায় আকবরের সিংহাসন  আরোহন করার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, আকবরী একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম যিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও বিনা বাধায় সিংহাসনে আরোহন করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং তার সিংহাসনে দাবি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি।মুসলমান রাজতন্ত্রে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়নে বংশানুক্রমিক অধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হতো না; অভিজাত দের মনোনয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে তো কোন প্রশ্নই ছিল না-তখন অভিজাতদের সিদ্ধান্ত সবচেয়ে গুরুত্ব পেত। তবে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আকবর বৈরাম এর মত এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি কূটনীতিবিদ কে পিতৃ বন্ধুত্বে সূত্রে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছিলেন বলেই আকবরের বংশানুক্রমিক অধিকারের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি, অথবা প্রশ্ন তোলার সম্ভাবনাকেই বৈরাম খান হয়তো নির্মূল করে দিয়েছিলেন। যদিও তখনো পর্যন্ত মোঘলরা ভারতবাসীর কাছে অনধিকার হিসেবে বিবেচিত হতেন; কিন্তু সেক্ষেত্রে আফগানরা অনধিকারী ছিলনা।এদিক দিয়ে বিচার করলে হুমায়ুনের সিংহাসনে আরোহণের দাবির ভিত্তি দুর্বল ছিল;কিন্তু আকবর সিংহাসনে আরোহন এর মধ্য দিয়ে সেই দুর্বলতা বিলুপ্ত হয়

Comments